গল্প- সারপ্রাইজ

সারপ্রাইজ
– পারমিতা ভট্টাচার্য

 

 

‘হতচ্ছাড়া ছেলে, তোকে না বিশ দিন বারণ করেছি ওকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করবি না।’ বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাটা বলে ওঠে অনিকেত তার ছয় বছরের ছেলে বাবাইকে।
বাবাই তো বাবার এহেন আচরণে প্রায়ই খুব অবাক হয়ে যায়। ওইটুকু একটা প্রাণী, তাকে দু’টো খেতে দিলে কী এমন ক্ষতি হবে, এটাই বুঝে উঠতে পারে না বাবাই। বাবাইয়ের সেই ভালোবাসার ‘ম্যাও’কে তার বাবা একদমই সহ্য করতে পারে না। রোজ সকাল বিকেল একটা বেড়াল বাবাইদের বাড়িতে আসতো। বাবাই সেই বেড়ালকে খেতে দিতো, মাথায় হাত দিয়ে আদর করতো। এক কথায় শহুরে জীবনে বাবাইয়ের ছোট্ট মনের একটু অক্সিজেন ছিল সেই বেড়ালটি। বেড়ালটি তার পোষ্য ছিল না কোনও দিনই। শুধুমাত্র দু’টো খাবার জন্য আর একটু ভালোবাসার জন্যই বেড়ালটা বাবাইয়ের পোষ মেনে গিয়েছিল। বাবাইয়ের মা সঞ্চয়িতা বাবাইকে এ ব্যাপারে কিছু বলতো না। সে বরং বাবাইকে একটু প্রশ্রয়ই দিতো। কারণ, বাবাই সে ভাবে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলো করার সুযোগই পেতো না। বাবাইদের বাড়ি ছিল লেক টাউনে। শহুরে জীবনে বন্ধু বলতে, খেলার সঙ্গী বলতে ওই বেড়ালটিই ছিল। বাবাইয়ের অবসর সময় কাটতো ওই ‘ম্যাও’কে নিয়ে। কিন্তু এর জন্য অনিকেত উঠতে, বসতে কথা শোনাতো মা ও ছেলেকে। অনিকেত নিজে উচ্চ শিক্ষিত এবং এম.এম. এন.সি-তে উচ্চ পদে কর্মরত। সে নিজে শিক্ষিত হওয়া সত্বেও বড় বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। ওই বাড়িতে আসা বেড়ালটাকে সে মোটেই দেখতে পারতো না। কারণ, বেড়ালকে সে চরম অপয়া বলে মনে করতো। কিন্তু ছোট বাবাই বিড়ালটার প্রতি স্নেহবশত বাবার কথাতে খুব একটা বেশি আমল দিতো না।

কিন্তু একদিন ঘটল ঘোর বিপত্তি। সে দিন ছিল অনিকেতের অফিসের জরুরি মিটিং। এই মিটিং আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব ছিল অনিকেতের উপর। এই মিটিং নিয়ে তাই সে খুব উত্তেজিত ছিল। সকাল সাত’টার মধ্যেই সঞ্চয়িতা অনিকেতের ব্রেকফাস্ট রেডি করে দেয়। অনিকেতও খুব তাড়াতাড়ি করে ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে যায় বেরোনোর জন্য। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। এমতাবস্থায় ঠাকুর প্রণাম করতে সে ঠাকুর ঘরে যায়। এটা তার বরাবরের অভ্যাস। ঠাকুর প্রণাম সেরে অনিকেত গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় বাবাইয়ের আদরের বেড়ালটা অনিকেতের রাস্তা কেটে চলে যায়। ব্যাস, আর কোথায় যায়? সে তো চিৎকার করে ওঠে। অপয়া বলে শাপ- অভিশাপ দিতে থাকে বেড়ালটাকে। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাই আর সঞ্চয়িতাকে বলতে থাকে – ‘আমার আজ এত বড় টেন্ডারের মিটিং আছে। এই মিটিংটা সাকসেসফুল হলে আমার প্রমোশনটা বাঁধা ছিল। তোমরা এর মর্ম কী বুঝবে? ঘরে বসে যা চাইছ তাই পাচ্ছ, ঠান্ডা ঘরে আরামে জীবন কাটাচ্ছ। আজ এই জরুরি কাজে বেরোনোর আগে ওই অপয়া বেড়ালটা আমার রাস্তা কেটে চলে গেল। সব শেষ হয়ে গেল আমার। আদৌ ঠিকঠাক অফিসে পৌঁছতে পারবো কি না, মিটিংটা সাকসেস হবে কি না তা ভগবানই জানেন। তোমাদের জন্য আজ আমার এত দিনের পরিশ্রম জলে চলে গেল। আজ আমি বাড়ী ফিরে যদি ওই অপয়াটাকে বাড়ীতে দেখি তাহলে তোমাদেরও ওর সাথে বাড়ী থেকে বের করে দেবো।’

সে দিন সকাল থেকেই বাবাই আর তার প্রাণের থেকেও প্রিয় ম্যাওকে ডাকলো না, আদরও করলো না, কিছু খেতেও দিলো না। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে দেখল বিড়ালটি তারই অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বাবাই তার মাথায় হাত বোলায়, দুধভাত খেতে দেয়। কিন্তু সে দিন বাবার বকুনির ভয়ে কিছুই করলো না। বাবাইও সে দিন স্কুল থেকে ফিরে কিচ্ছু খেলো না। অন্য দিকে বিড়ালটির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সঞ্চয়িতাও। দরজার ওপারে এক নাগাড়ে বিড়ালটা মিউ মিউ করে ডেকেই চলেছে। কেউ দরজা খোলেনি আজ। ছোট্ট বাবাই কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়।

অন্য দিকে অনিকেতের মিটিং সাকসেসফুল। টেন্ডারটা তাদের কোম্পানি পেয়ে গেছে। কোম্পানি সব ক্রেডিটটাই অনিকেতকে দিচ্ছে। তাই এবার তার প্রমোশনটাও একেবারে পাকা। এই খুশির খবর সে বাড়িতে ফোন করে জানালো না। ভাবলো বাড়ি গিয়ে সঞ্চয়িতাকে সারপ্রাইজ দেবে। বাবাই মিষ্টি ভালোবাসে তাই তার জন্য একটু মিষ্টি কিনে অনিকেত বাড়ি ফিরলো রাত আট’টায়। কলিংবেল বাজলেই
অন্যদিন বাবাই ছুটে আসে দরজা খুলতে, আজ দরজা খুললো সঞ্চয়িতা। সঞ্চয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে অনিকেত বললো- ‘আজকের মিটিং সাকসেফুল হলো আমার। আমরা টেন্ডারটা পেয়ে গেছি।’ কিন্তু ভাবলেশহীন সঞ্চয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিকেত কিছু অঘটনের আঁচ পেলো। সে জিজ্ঞেস করলো সঞ্চয়িতাকে- ‘বাবাই কোথায়? কিছু হয়েছে নাকি? তখন সঞ্চয়িতা কান্না ভেজা গলায় বললো- ‘তুমি সকালে বলে যাবার জন্য আজ আমরা কেউ বেড়ালটাকে খেতে দিই নি। এমন কি ঘরেও ঢুকতে দিই নি আজ একবারও। সারাদিন সে ঘরের বাইরে মিউ মিউ করে ডেকে গেছে।স্কুল থেকে ফিরে বাবাইও আজ কিচ্ছু খাইনি। কেঁদে কেঁদে আমার কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিলো।বিকালে একটু বাড়ীর বাইরে বাবাইকে নিয়ে দোকান যাওয়ার সময় দেখি রাস্তার পাশে বিড়ালটির রক্তাক্ত, নিথর দেহটা পড়ে আছে। বাবাই তো দেখেই চিৎকার করে উঠেছিল। ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরেই হয়ত অন্য কারোর বাড়ীতে যাচ্ছিল বেড়ালটা। রাস্তা পেরোনোর সময় কোনো গাড়ী তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। সেই থেকেই বাবাই ঘরে চুপ করে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। কিছু বোঝালেও বুঝছে না।’
অনিকেত সব শুনে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারলোনা। একটা বিশ্রী অপরাধবোধ ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। আজ অনিকেত প্রসন্ন মনে বাড়ীতে একটা সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল কিন্তু বাড়ী ফিরে এসে নিজেই একটা ভয়ঙ্কর সারপ্রাইজের সম্মুখীন হলো। আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়ে চেয়ারে চুপ করে মাথাটা দু’হাতে চেপে বসে রইলো। আর মনে মনে এটাই ভাবতে লাগলো যে, কে কার জন্য অপয়া হলো আজ? বিড়ালটা তার জন্য নাকি সে বিড়ালটার জন্য?

Loading

Leave A Comment